অনেক বেদনা সয়ে; জুয়েলের বেঁচে থাকা

তাওসিফ আকবরঃ পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানী উপজেলার রামচন্দ্রপুর এর বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন একজন মানুষ জাহিদুল ইসলাম জুয়েল। এক চোখ,অর্ধ সচল দুইহাত ও এক পায়ে সমস্যা নিয়েও নিজেকে অধ্যবসায়ের আদর্শ উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এই মানুষটার নামের সাথে প্রতিবন্ধী শব্দটা লিখতে হাত কাঁপলেও অগত্যা অনুমতি নিয়েই প্রতিবেদন এর স্বার্থে উল্লেখ করতে হচ্ছে।

নষ্ট ডান চোখ, দুইহাত পর্যাপ্ত নাড়াতে পারেননা, খুব বেশি উঁচুতেও উঠাতে পারেননা, অকেজো বাম পা আর অর্ধ সচল দুইহাত নিয়ে ২০১১ সালে ইন্দুরকানী ডিগ্রী কলেজে (বর্তমানে ইন্দুরকানী সরকারি কলেজ) থেকে কৃতিত্বের সাথে বিএসএস পাস করেন তিনি। কর্ম করতে না পারা পিতাসহ পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন ছাত্রাবস্থাতেই।

মধ্যবিত্তের কিছু সীমাবদ্ধতায় যেখানে আমরা নিয়মিত বিরতিতে আফসোস করি আর হতাশায় ভুগে সমাজ সংসারকে দোষারোপ করি সেখানে অকেজো পা-টা নিয়েও এক-চোখে সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। সামান্য কিছু না পাওয়া আর অপূর্ণতায় যখন আমরা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেই তখন পরিবারের ঘানি টানতে গিয়ে ক্লান্ত জুয়েলের অভিযোগের ফুরসত কই?

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া পরিবারের হাল ধরতে টিউশনির কাজ করেছেন, নিজের পড়ালেখার খরচ জুগিয়ে পরিবারকে সহায়তা করেছেন।পাওয়ার স্টেশনের কাজ যেখানে একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের জন্যও ঝুকিপূর্ণ সেই কাজ নষ্ট চোখ আর অকেজো পা নিয়েও শুধুমাত্র ইচ্ছেশক্তির জোরে করে গেছেন কোনো অভিযোগ ছাড়াই। বস্তুত পরিবারের জন্য করতে হয়েছে, করতে হয়। দুই পায়ে ভর করে দাঁড়িয়েও শক্ত কাঁধে যে মধ্যবিত্ত সংসারের হাল ধরতে মানুষ হিমশিম খায় সেই সংসারকে চালাতে গিয়ে একপায়ে ভর করা কাঁধেও বয়েছেন অন্যদের মতো প্রায় সমান ভার।

নিজেকে কখনও প্রতিবন্ধী ভাবেননি, প্রতিবন্ধীরা যে সমাজের বোঝা নয় তাদের প্রাপ্য অধিকার আর পর্যাপ্ত সুযোগ পেলে তারাও নিজেদেরকে প্রমাণ করতে পারে সেই কথা পুস্তকে আবদ্ধ লাইন থেকে বাস্তবতায় প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। কখনও করুনার পাত্র হননি। অভাবের সংসারে সুস্থ সবল পুত্রের পিতাকে দোষারোপ করার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে এসে প্রতিবন্ধকতা নিয়েও কর্মহীন অসুস্থ বাবাসহ পুরো পরিবারের হাল ধরেছেন।

হাজারও প্রতিবন্ধকতা জয় করে আশা-জাগানিয়া মানুষটা করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট সংকটের পর থেকে নানা কারণে নানাভাবে স্ত্রী-সন্তান, পিতা-মাতাসহ পরিবারকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন।

এমন মানুষদের যদি সাপোর্ট না করে আমরা বিপদের দিনে পাশে না দাঁড়াই, মুখ থুবড়ে পরতে দেই, তবে পরবর্তীতে আর কোনো প্রতিবন্ধী মানুষ তাদের প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার সাহস দেখাবেনা। তিল তিল করে গড়া জুয়েলের এই আত্মবিশ্বাসকে আমরা নষ্ট হতে দিতে পারিনা, এই অধ্যবসায় বিফল হতে দিতে পারিনা। আমরা জুয়েলদের এভাবে হেরে যেতে দিতে পারিনা।

এখনই সময় সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার, এখনই সময় জুয়েলের জন্য স্থায়ী কিছু একটা করার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *