ওয়ার্ড পর্যায়ে নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর থেকে নমিনেশন পেয়েও নৌকা হেরে গেলেন সিনিয়র নেতাদের জন্য
গত ৭ ফেব্রুয়ারি সপ্তম ধাপে অনুষ্ঠিত হয় পিরোজপুরের ইন্দুরকানী উপজেলার ৫নং চন্ডিপুর ইউপি নির্বাচন। প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হওয়া এ ইউপিতে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পান ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান স্বপন মাঝি। আওয়ামী লীগের চেয়ে এখানে বিএনপি-জামাতের ভোটের অবস্থান বেশি থাকলেও একজন স্বচ্ছ রাজনীতিবিদ হিসেবে ব্যক্তি ইমেজে আগানো ছিলেন তিনি। কিন্তু অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে নৌকার পরাজয় নিয়ে দলীয় নেতাকর্মী এবং সাধারন ভোটারদের মাঝে চলছে এখন চুলছেড়া বিশ্লেষণ।
এ ইউনিয়নটিতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, কৃষক লীগের সভাপতি সহ উপজেলা কমিটির ৯ জন গুরুত্বপূর্ণ নেতার বাড়ি। তবে তাদের প্রায় সকলের কোন না কোন আত্মীয় ওই ইউনিয়নে ইউপি সদস্য পদে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডেই দলের বেশ কিছু নেতা মেম্বার পদে অংশ নেন নির্বাচনে। ফলে প্রায় সকলেই ব্যস্ত ছিলেন নিজের আত্মীয় ও দলীয় মেম্বারদের নির্বাচিত করা নিয়ে। তাদের এ আত্মসম্মান রক্ষায় পিছনে ছুটতে গিয়ে নৌকার যে ভরাডুবি হচ্ছে সে বিষয়ে খেয়াল ছিল না কারোই। অনেকে মনোনয়ন চেয়ে না পেয়ে রয়েছেন নিষ্কিয়। কিছু নেতাকর্মি গোপনে আর্থিক কিংবা অন্য সুবিধা নিয়ে বিজয়ী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সহ মাঠ পর্যায়ের দলীয় কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম ক্ষোভ। তাছারা জেলা আ.লীগের নেতাদেরও এ ইউনিয়নটির নির্বাচন নিয়ে ছিলনা কোন মাথা ব্যথা। নির্বাচনের শুরু থেকে দলের অধিকাংশ নেতাকর্মিকে মাঠে না পেয়ে চরম হতাশায় ছিলেন নৌকার প্রার্থী।
শেষ মুহুর্তে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি,পারেরহাট ও বালিপাড়ার ইউপি চেয়ারম্যানসহ উপজেলা আওয়ামী লীগ,যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ আপ্রান চেস্টা করলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের জোর তাগিদ দিয়েও অনেকই নির্বাচনী মাঠে নামাতে ব্যর্থ হন তারা ।
সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শুধু নেতাকর্মীরা ঐক্য বদ্ধ না থাকায় জয় হাতছাড়া হয় আ.লীগের। অন্যদিকে নৌকার প্রার্থীর নিজের নির্বাচনী কূটকৌশলও ছিল অনেকটা দুর্বল।
নির্বাচনে দলের ৫০ ভাগ নেতাকর্মী নৌকার পক্ষে মাঠে নামেননি। বরং বিভিন্ন ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থীদের সাথে প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলেন। সাথে নৌকার বিপক্ষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবস্থান নিয়েছেন এরা। মাঠে নামা বাকি ৫০ ভাগ নেতাকর্মীদের মধ্যে ৩০ ভাগ নেতাকর্মী সক্রিয়ভাবে নৌকাকে জেতাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালালেও এর মধ্যে ২০ ভাগ নেতাকর্মী দায়সারা ভাবে কাজ করেছে এবং আবার এদের মধ্যে অনেকেই বিজয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মী সমর্থকদের সাথে গোপনে আতাত করেছেন।
বিভিন্ন ওয়ার্ডে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে মাঠ পর্যায়ের আওয়ামী লীগের এক থেকে দেড় হাজার নেতাকর্মী সমার্থকদের ভোট নৌকার বিপক্ষে চলে গেছে। এ ইউনিয়টিতে সাড়ে চার শতাধিক হিন্দু ভোটার থাকলেও প্রায় ৩০ ভাগ হিন্দুদের ভোট চলে গেছে সাইকেল প্রতীকে।
দু’একজন ছাড়া এই ইউনিয়ন থেকে মুক্তিযোদ্ধারাও নৌকার পক্ষে মাঠে নামেননি। এ নয়টি ওয়ার্ডের মধ্যে শুধু একটি কেন্দ্রে জয়লাভ করে নৌকার প্রার্থী।
বিএনপি জামায়াতের অধিকাংশ নেতাকর্মী সাইকেল প্রতীকের প্রার্থীর প্রচারণায় অংশ নেয়ায় সাধারন ভোটারদের অনেকেই ভয়ে ভোট দিয়েছেন মন্জুকে এমনটা মন্তব্য অনেকের।
এদিকে বরাবরের মতো ৩, ৪ ও ৫ নং ওয়ার্ড গুলো আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত থাকলেও এ তিনটি ওয়ার্ডে তিন হাজার ভোটের মধ্যে নৌকা পেয়েছে মাত্র ৫৯০। অথচ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বাড়ি এই তিনটি ওয়ার্ডে।
এ ইউনিয়নে জাতীয় পার্টি (জেপি- মঞ্জু) মনোনীত মোঃ মশিউর রহমান মঞ্জু বাইসাইকেল প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন। মঞ্জু নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর চেয়ে ২ হাজার ২৭৯ ভোট বেশি পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ইন্দুরকানী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম মতিউর রহমানের বাড়ি চন্ডিপুর ইউনিয়নে। এ ইউনিয়ন থেকে তার ঘনিষ্ট ২ আত্মীয় ইউপি সদস্য হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয়। তবে তারা নির্বাচনে কেউই বিজয়ী হতে পারেননি। ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানও নিজের ভোট কেন্দ্রে এজেন্ট ছিলেন এক মেম্বার প্রার্থীর। যেসব ওয়ার্ডগুলোতে আ.লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদধারী নেতাদের বাড়ি সেসব কেন্দ্রগুলোর একটি তোও জিততে পারেনি নৌকা।
এছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ মনিরুজ্জামান সেলিম তার প্রতিবেশী। তার আপন ভাইও ইউপি সদস্য হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তিনি সারে ছয়’শর বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হলেও তার কেন্দ্রে নৌকা প্রতীক পেয়েছে মাত্র ২৩৪ ভোট। অন্যদিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সদস্য মোঃ আবুল কালাম আজাদ ইমরানের ঘনিষ্ট এক আত্মীয় পশ্চিম চরবলেশ্বর ওয়ার্ডে ইউপি সদস্য পদে নির্বাচনে অংশ নেয়। ইমরান এ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন।
এছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের এক সহ-সভাপতি, উপজেলা আ.লীগের প্রচার সম্পাদক এবং উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান,মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদকের বাড়িও চন্ডিপুর ইউনিয়নে। এক ইউনিয়নে এত নেতা থাকলেও নৌকা প্রতীকের পক্ষে বিভিন্ন পর্যায়ের দলীয় নেতাকর্মীদের কাজ করতে মাঠে নামতে পারেননি। তার অভিযোগ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেলিম এবং সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান এর বাড়ি একই ওয়ার্ডে। এছাড়া তাদের ঘনিষ্টজন ইউপি সদস্য পদে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তারা তাদের স্বজনদের জন্য কাজ করেছে। এছাড়া নির্বাচনে তারা তেমন কোন সহযোগীতা করেনি বলেও অভিযোগ স্বপন মাঝীর। এই দুই নেতার সাথে সাইকেলের প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনাকারী দুই জামায়াতের লোকের সম্পর্ক ছিল বলেও অভিযোগ তার। এছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ডে দলীয় মেম্বার প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ার জন্য সাইকেল মার্কার প্রার্থীর সাথে গোপনে আঁতাত করে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ তার।
অন্যদিকে দলের কোন নেতাকর্মীকে নির্বাচন পরিচালনার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মৃধা মোঃ মনিরুজ্জামান। তারও অভিযোগ উপজেলা পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা থাকা সত্ত্বেও দলের প্রতি তাদের তেমন কোন ভূমিকা ছিলনা।
তবে দলের নেতৃত্বে থাকা নেতাদের কাছ থেকে কোন দায়িত্ব না পেলেও, নিজ উদ্যোগে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর জন্য কাজ করেছেন বলে জানিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান। তিনি জানান,চন্ডিপুর ইউপি নির্বাচনে বেশ কয়েকটি নির্বাচনী উঠান বৈঠকে অংশ নিয়েছেন তিনি।
তবে অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ মনিরুজ্জামান সেলিম বলেন, আমি নৌকার লোক। নির্বাচনে নৌকাকে জেতাতে সার্বক্ষণিক প্রচার প্রচারণায় মাঠে ছিলাম।
সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ ইমরান জানান,নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর জন্য কাজ করেছেন তিনি। তবে প্রার্থী যথাযথ না হওয়ায় তিনি হেরেছে বলে দাবি করে।
নির্বাচনী প্রচারণায় না নামা দলের বেশ কয়েকজন সাধারণ কর্মী সমর্থকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান,নির্বাচন আসলেই ভোটের জন্য আমাদের খোঁজ করে নেতারা। কিন্তু আমাদের নানা সুবিধা অসুবিধায় তারা কখনো খোঁজ নেয়না। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলেও আমরা দলের কর্মী সমর্থকরা সরকারের দেয়া নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। অথচ কৌশলে এখানে শতকরা আশি ভাগ জেপি এবং বিএনপি জামায়াতের অনুসারীরা সরকারী সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। এসব বিষয় নিয়ে দলীয় নেতাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই।
তবে অধিকাংশ নেতার স্বজন ও দলের কর্মী সমর্থকরা ইউপি সদস্য প্রার্থী নিয়ে ব্যস্ত থাকায় নৌকার পরাজয় হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম মতিউর রহমান। এছাড়া অনেকেই দায়িত্ব নিতে তার কাছে না যাওয়ায় কাউকেই নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া সম্ভব হয়নি বলেও দাবি তার।
এক ইউনিয়নে উপজেলা পর্যায়ের এতগুলো নেতা থাকার পরও নৌকার এ পরাজয়ের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে তদন্ত করে দেখার জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন পরাজিত প্রার্থী এবং পক্ষে কাজ করা আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীরা। তবে নৌকার এ হার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলকে ব্যাপক ভাবে প্রভাব ফেলবে বলে দলের সাধারণ কর্মিদের।