গত দেড় বছরে পিরোজপুরে পানিতে ডুবে মারা গেছে ১৪টি শিশু, ‘সমষ্টি’র বিশ্লেষণ

এবারই প্রথম ২৫ জুলাই (আজ রোববার) আন্তর্জাতিকভাবে ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ’ দিবস পালিত হচ্ছে। তবে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুকে ‘নীরব মহামারি’ অভিহিত করে বেসরকারি পর্যায় থেকে দীর্ঘদিন ধরে জনসচেতনতা, সরকারি নীতি প্রণয়নের দাবি জানালেও কার্যত দেশে সে রকম কোনো উদ্যোগ নেই।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২৩ জুলাই পর্যন্ত ১৯ মাসে দেশে পানিতে ডুবে ১ হাজার ৫৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর ৮৩ শতাংশই শিশু। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগের ১২৭টি। অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব এবং সাঁতার না জানাই এই মৃত্যুর প্রধান কারণ।ৎ

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) সূত্র জানায়, চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ বিষয়ে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর প্রস্তাবক ছিলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা। এতে পানিতে ডুবে মৃত্যুকে একটি ‘নীরব মহামারি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের ৭৫ বছরের ইতিহাসে এ ধরনের রেজল্যুশন এটাই প্রথম।বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুমৃত্যুর জন্য দায়ী বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকে বৈশ্বিকভাবে এসডিজির অন্তর্ভুক্ত করা হলেও পানিতে ডুবে মৃত্যুকে অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত করা হয়নি। ফলে অসুস্থতার কারণে শিশুমৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হলেও পানিতে ডুবে মৃত্যু কমছে না। জাতিসংঘের স্বীকৃতি দেওয়ায় এখন এটি আলাদাভাবে গুরুত্ব পাবে।

পানিতে ডুবে মৃত্যুর বিষয়ে ২০১৪ সালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ড্রনিং’ শিরোনামে বিশ্ব প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা বিশ্বে প্রতিবছর ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৪০০ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। তাদের ২০ শতাংশের বয়স ৫ বছরের কম। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হারে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে ১ থেকে ৪ বছর বয়সী শিশুদের মোট মৃত্যুর ৪৩ শতাংশ হয়েছে পানিতে ডুবে। সংস্থাটি বলেছিল, সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।বিজ্ঞাপন

আগে বর্ষা মৌসুমে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বেশি হলেও এখন সারা বছরই এই মৃত্যুর শিকার হচ্ছে শিশুরা। এর সঙ্গে নতুন উপসর্গ যোগ হয়েছে উপকূলে অধিক উচ্চতার জোয়ার। জোয়ারের পানিতে লোকালয় প্লাবিত হওয়ায় সম্প্রতি শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। গত মে মাসের জোয়ারের পানিতে ডুবে বরিশালসহ উপকূলীয় এলাকায় ১১ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে নয়টিই শিশু।

সকাল নয়টা থেকে বেলা দুইটার মধ্যেই সাধারণত পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে। এ সময় মায়েরা সাংসারিক নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। বাবারা কাজের জন্য বাড়ির বাইরে যান।

১৯ মাসে ১ হাজার ৫৬২ মৃত্যু
পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা প্রতিরোধে সচেতনতা ও তথ্য সংরক্ষণ করে গণমাধ্যম ও উন্নয়ন যোগাযোগবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত বিশ্লেষণে জানায়, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২৩ জুলাই পর্যন্ত ১৯ মাসে দেশে পানিতে ডুবে মারা গেছে ১ হাজার ৫৬২ জন। এদের ৮৩ শতাংশই শিশু। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে মৃত্যু হয় ১২৭টি শিশুর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় পটুয়াখালীতে ৩৯টি, এরপর রয়েছে বরিশালে ৩৩, বরগুনায় ১৫, ভোলায় ১৩, পিরোজপুরে ১৪ ও ঝালকাঠিতে ১২টি শিশু। বিভাগে মারা যাওযা ১২৭টি শিশুর মধ্যে শূন্য থেকে ৪ বছর বয়সী ৭১টি, ৫ থেকে ৯ বছরের ৪০টি এবং ১০ থেকে ১৮ বছরের রয়েছে ১৬টি শিশু।

শিশু ও বিভিন্ন দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা বলছেন, সবার ধারণা দেশে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি শিশুর মৃত্যু হয়। কিন্তু আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিআইপিআরবির পরিচালক আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নজরে আনতে কাজ করছি। জাতিসংঘ ২৫ জুলাইকে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করায় বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেল। এই মৃত্যু প্রতিরোধে সরকারিভাবে একটি নীতি প্রণয়নের জন্য আমরা দীর্ঘদিন কাজ করছি। এ–সংক্রান্ত একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটির ডিপিপি একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায়।’

আমিনুর রহমান আরও বলেন, এই মৃত্যু রোধের ক্ষেত্রে শিশুদের সাঁতার শেখা, পরিবারের সচেতনতা এবং সরকারিভাবে বিষয়টি প্রতিরোধে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

কৃতজ্ঞতা

প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *