দেশে ফিরলেও বাড়ি ফিরতে পারেনি ইন্দুরকানীর সেই আরিফ!

লেখাটি ফেসবুক থেকে নিয়ে মতামত বিভাগের আওতায় প্রকাশিত

তাওসিফ আকবর: সত্যিই বোধহয় কিছু জীবন এমন থাকে যাকে আপনি পলাশীর যুদ্ধের সাথে তুলনা করতে পারবেন। পরবর্তী ২০০ বছরের দাসত্বের সেই আখ্যান যেন এখনও তৃতীয় বিশ্বের মানুষদের সাথে ঘটে এবং ঘটে চলছে। মীরজাফর কিংবা ঘষেটি বেগমের ন্যায় আদম ব্যবসায়ী দালাল আর বিদেশের মাটিতে বসে খেটে খাওয়া মানুষদের স্বপ্নভঙ্গের নটরাজ কন্ট্রাক্টর; তারা উদিত সূর্য্যের গতিপথ থামিয়ে পরবর্তী জীবনে কেবলই রাত নামায়। ধোঁকায় পড়ে সর্বস্ব খুইয়ে আসা প্রবাসীদের সেই রাতের যেন আর ভোর হতে চায়না।

উপরের লেখাটাকে একটু অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা আপনার মনে হতেই পারে। তবে যার কাছে খুব বেশি প্রাসঙ্গিক আর একইসাথে বেদনাবিধূর, তিনি আমাদেরই একজন। পিরোজপুরের ইন্দুরকানী উপজেলার সেউতিবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম আকাশ। এইটুকু বয়সেই এক আকাশ দুঃখের ইতিহাস তার ঝুলিতে। [নামটা তার ফেসবুক থেকে হুবহু নেওয়া]

উপরের ভিডিও প্রতিবেদন দেখে চোখে জল আসা খুব স্বাভাবিক, বরং না আসাটাই অস্বাভাবিক। এই প্রসঙ্গটা টানার আগে শিরোনামের বিষয়টা স্পষ্ট করা যাক। একটি দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকটা জীবন-মৃত্যুর অনিশ্চিত দুয়ার পেরিয়ে কোনোমতে আরিফ দেশে ফিরলেও বাড়ি ফিরতে পারেনি এখনো। এই না পারার পেছনে ওর ইচ্ছেকে দোষারোপ করাটা আমাদের বোকামি হতে পারে। ওর দিকটা আমরা কখনোই বুঝবোনা। এমনকি চাইলেও বুঝতে পারবনা।

আরিফ হয়তো ভাবছে পরিবারের শেষ সম্বলটুকুও (পুঁজি) খুইয়ে কোন মুখে বাড়ি ফিরবে। বাড়ি না ফেরার পক্ষে অনেকগুলো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে ওর। হয়তো নিজেকে খুব দোষী ভাবছে ও। কিন্তু এইখানে দায়টা মোটামুটি রাষ্ট্র, দায়িত্বশীল ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান কিংবা নিদেনপক্ষে আমি-আমরাও এড়াতে পারিনা। অন্তত আমার তো সেটাই মনে হয়।

সমাজব্যবস্থার শুরু থেকে অনেক কিছুর উন্নতি তো হয়েছে কিন্তু তবুও কোথাও যেন একটা কিছু বাদ রয়ে গেছে। কি এক অদ্ভুদ লম্বা রেসে আমাদেরকে নিয়োজিত রাখছে সমাজ, সমাজের মানুষেরা আর প্রভুর বেশভূষায় সেজে বসে থাকা ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান। সমাজ একজন মানুষকে যেই মাপকাঠিতে বিচার করে সেই আদর্শ মাপকাঠির মান নিয়েই আছে প্রশ্ন, আছে সমালোচনা। যুগের সাথে সাথে আমাদের সমাজের কর্তাব্যক্তিদের হাতে থাকা মুঠোফোনটি তো বদলেছে কিন্তু ধারণাটা আর বদলায়নি। রয়ে গেছে বদ্ধমূলে। যাক এই আলোচনা অন্তত এখন আর শুরু করতে চাইনা। অপ্রাসঙ্গিক লাগতে পারে-

আরিফের যেই মা গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন, বাবা স্টেরিওটাইপ ভেঙ্গে পুরুষ হয়েও ঠুকরে কেঁদে ফেলেছেন। সেই তারাই যখন আরিফকে দেশে ফেরার পর এখন পর্যন্ত একবার সামনাসামনি দেখতে পারেননি, তখন বোঝা যায় এখানে আকাশ সম দুঃখ আছে, দারিদ্যের বাঁধা আছে, আছে অভিমান আর ক্ষোভ।

আরিফের সাথে যেটা হয়েছে সেটাকে এখন একপ্রকার মানবপাচার বলা যায় বোধহয়। আর কোনো আরিফের সাথে এমনটা যেন না হয় সেটা নিশ্চিতে রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগ, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তদারকি, আর আমাদের সমাজের বদ্ধমূল ধারণার পরিবর্তনটা কার্যকরীভাবে হওয়া প্রয়োজন। কোনো একটাতেও ঘাটতি থেকে গেলে কে জানে আবার কবে কোনো মা’কে বুখ ফাঁটা কান্না করতে হয়।

মানবপাচারকারীদেরকে আইনের আওটায় আনা হয়েছে কিনা কে জানে? সার্চ করে এমন কিছু পেলাম না। অবশ্য টেবিলের নিচ দিয়ে মানবপাচারকারীরা হরহামেশাই বেঁচে যায়। কিন্তু যারা এখনও এই কথিত নরক থেকে দেশে ফিরতে পারেনি তাঁরা বাঁচবে তো?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *