নীল দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া আক্ষেপ

Tausif Akbar: গত হয়ে যাওয়া অনেক হারানোর সাল ২০২০। পৃথিবী ব্যাপীয়া শুধু হাহাকার; সবাই শুধু হারিয়েছে। অমন হারানোর বছরটাকে পেছনে ফেলে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার অপেক্ষার পালা শুরু। এইতো ডিসেম্বর আসতেই বিজয়ের মাস লিখে যে জয়ধ্বনি দিয়েছিল সবাই, সেটাও শেষ হয় ১৬ তারিখে। এরপর ২৫ তারিখে বড়দিন পেরিয়ে বছরের শেষরাত্রি আর নতুন একটি বেদনাহীন বছর আগমনের অপেক্ষা।

কিন্তু ১৬ তারিখের সেই বিজয়ের দিনটি দেখা হয়নি মারুফের। পুরো নাম লিয়ন আল মারুফ। ডিসেম্বরের ০৮ তারিখেই সন্ধ্যের আকাশটা ঘনকালো মেঘে ছেয়ে গেল। বিষন্নতার মাত্রার তীব্রতায় প্রকৃতির চোখও জলে ঝাপসা হয়ে এল, ভীষণ কুয়াশায় ছেয়ে গেল চারিপাশ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নামের পাশে “মৃত্যুপথযাত্রী” লিখে রাখা লিয়ন আল মারুফের যাপিত জীবনের এ-পারের যাত্রা থামলো এখানেই। বাসের সাথে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষ একটা প্রক্রিয়া মাত্র। এরকম সংঘর্ষ হয়েও হাজার মানুষ বেঁচে আছে; ও বাঁচেনি।

জাগতিক সমস্ত ব্যাপারেই মানুষ সবজান্তা নয় সেখানে ভবিষ্যতব্য বিষয়াবলীর তো প্রশ্নই আসেনা। তবুও একটা কিন্তু রয়ে যায়! নইলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেন সে লিখে রাখবে “যখন আমি থাকবনা, তখন আমায় খুঁজো না।” শুধু মনে করে একটু ভালোবাসা উড়িয়ে দিও।”

ওর ফেসবুকে দেয়া –রাত গভীরে মন খারাপ হয়, বুকে চাপা কষ্ট থাকে; এসব স্ট্যাটাসগুলো অক্ষরে অক্ষরে সত্য ওর গর্ভধারিণী মায়ের ক্ষেত্রে। ভীষণ রাতে তার কি হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়না? পাহাড়সম কষ্ট বুকে সে কি আর্তনাদ করেনা? অবশ্যই করে; বারংবার করে!

মারুফের দেওয়া –“ চাওয়া বেশি হলে তুমি ঠকবেই ” স্ট্যাটাসটার সাথে অতিমাত্রায় মিল আছে ওর বাবার ক্ষেত্রে। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তার কতইনা চাওয়া ছিল! একমাত্র অবলম্বন ছিল; ওকে নিয়ে কতশত চাওয়ার পরে সেই ঠকলোইতো!

এ-সবই আমরা লোকমুখে শুনি। একটি সাঁকো পেরিয়ে দেখতে যাওয়া হয়নি আর। দেখতে যাওয়া হয়নি সন্তান হারানো মায়ের বেদনা। দেওয়া হয়নি শান্তনা।

পথে কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি ওর বাবাকে সে কেমন আছে। ভালো নেই সেটা চিরন্তন। তবু মিনিট খানেক সময় বের করে তার দুঃখবোধ ভাগাভাগি করা হয়নি।

খুব করে আমরা সবাই ফেসবুক পোস্ট দিয়েছিলাম; সবাই একটা করে। পরেরদিন ভুলতে গিয়েও পাশে কেউ না কেউ আলাপ করে মনে করিয়ে দিয়েছিল।এরপরেরদিন শোনা গেল মিলাদ আছে। এরপর যেদিন মিলাদ বা দোয়া মাহফিল হলো সেদিন সেই যে প্যাকেট নিয়ে ফিরলাম আর কখনোও ওমুখোই হইনি আমরা।কি সেটাই তো?

আমরা সবাই ভুলে গেলেও দশমাস দশদিন গর্ভে অসহনীয় বেদনা যিনি সয়েছেন তিনি কি করে ভোলেন? যেই বাবা কাঁধে করে ঘুরেছেন, আঙ্গুল ধরে হাঁটতে শিখিয়েছেন তিনি কি করে ভোলেন?

যার চলে যায় সে-ই বোঝে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা- হারানোর বেদনা। আমাদের না হয় বন্ধু, ভাই, ছোটভাই কিংবা বড়ভাইয়ের অকাল মৃত্যু। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে তো নীল দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া ভীষণ আক্ষেপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *