৮১ বছর পর পশ্চিমবঙ্গের মহাদেব দাস যেভাবে তাঁর পিরোজপুরের জন্মভিটা খুঁজে পেলো

লেখা সমন্বয় করেছেন তাওসিফ আকবর:

জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে ৮১ বছর পর পশ্চিমবঙ্গের মহাদেব দাস তাঁর পিরোজপুরের জন্মভিটা তথা বাপ-দাদাদের আমলের বসতভিটার খোঁজ পেলেন। একটি ফেসবুক পেজ আর মঠবাড়িয়ার কিছু মানুষের কল্যাণে তাঁর এই মনের ইচ্ছা পূরণ হয়।

শুরুটা হয়: বাংলাদেশের পিরোজপুরের মানুষের সহায়তা চেয়ে এক ভারতীয় নারী একটি ফেসবুক পেজে পোস্ট করেছিলেন এ বছর জুন মাসের শুরুর দিকে। তার আকুতি ছিল যে প্রায় আশি বছর আগে ফেলে আসা একটা বাড়ির খোঁজ যদি পিরোজপুরের কেউ দিতে পারেন।

‘বঙ্গ ভিটা’ নামের ফেসবুক পেজের সেই পোস্টে শ্বেতা রায় নামের ওই ভারতীয় নারী লিখেছিলেন পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার হারজি গ্রামের কথা। “গ্রামের পাশে একটা খাল আর খালের পাশেই বাড়ি ছিল”।

সেটা ছিল তার মায়ের বাবা, অর্থাৎ দাদু মহাদেব দাসের বাড়ি। কাজটা ছিল একরকম ‘খড়ের গাদায় সুঁচ খোঁজার’ মতো। তবে সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় মাত্র ১৮ দিনের মাথায় খুঁজে পাওয়া যায় পিরোজপুরের মহাদেব দাসের ফেলে আসা বাড়ির সন্ধান, পাওয়া যায় সেখানকার ছবিও।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় বর্তমানে মহাদেব দাসের জন্মভিটার বর্তমান অবস্থা/বঙ্গ ভিটা ফেসবুক পেজ

শ্বেতা রায় এর বক্তব্য অনুযায়ী, পোস্টটা দেখে প্রথম যিনি যোগাযোগ করলেন, তিনি হলেন ফজলে আলি খানের নাতির নাতি। এই ফজলে আলি খানই আমার দাদুর পরিবারকে স্বাধীনতা-পূর্ব দাঙ্গার সময়ে বন্দুক নিয়ে রাত জেগে পাহারা দিতেন। এই ভদ্রলোক নিজের নাম জানাতে চান না অবশ্য। এরপরে এমন একজনের সাহায্যে সব তথ্য পাই, যিনি আবার বাড়িটির বর্তমান বাসিন্দাদের পরিচিত।“

“দাদু তো ভাবতেই পারে নি যে এতবছর পরে আবার তাদের ফেলে আসা বাড়ির ছবি দেখতে পাবে। ওই ছবিগুলো দেখে একবারেই চিনতে পেরেছে। বারবার বলছিল বাড়িটা, পাশের খালটা এখনও আছে, তবে একটা বটগাছ ছিল, সেটা কেটে ফেলা হয়েছে,” জানাচ্ছিলেন ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসাবে কর্মরত শ্বেতা রায়।

মেয়ের (শ্বেতার মা) সঙ্গে মহাদেব দাস (বাঁয়ে), পিরোজপুরে মি. দাসের পৈত্রিক বাড়ি (ডানে)

এভাবে ৮১ বছর পর ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বাসিন্দা মহাদেব দাসের জন্মভিটার সন্ধান পায়। বঙ ভিটা ফেসবুক পেজ অনুযায়ী, ১৯৪৩ সালের দিককার কথা। বৃহত্তর বরিশালের পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার বড় হারজি গ্রামের ছোট্ট কিশোর মহাদেব দাস মাত্র ৫/৬ বছর বয়সে জন্মভিটা ফেলে পরিবারের সাথে পাড়ি জমান ওপার বাংলায়। কিশোর মহাদেব দাসের প্রাথমিক শিক্ষাজীবনের কিছু সময় কাটে এই মঠবাড়িয়ায়। প্রিয় জন্মভূমি, সবুজ গ্রাম, মাঠঘাট, প্রিয় বন্ধুদের ফেলে চলে যেতে হয় ওপার বাংলায়। এরপর মহাদেব দাসের জীবন থেকে কেটে যায় ৮১ টি বছর।

মহাদেব দাসের বর্তমান বয়স ৮৫/৮৬ হবে। শারীরিক ভাবে তিনি ভীষণ অসুস্থ। জীবন সায়াহ্নে এসে মহাদেব দাস প্রিয় মাতৃভূমি পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়ার বড় হারজি গ্রামের জন্মভিটার ছবি দেখার তীব্র ইচ্ছা প্রকাশ করলে, মহাদেব দাসের নাতনি শ্বেতা রায় রিমি বঙ্গ ভিটার বন্ধুদের শরণাপন্ন হয়।

এরপরই ঘটে যায় অনেকটা মিরাকল। মঠবাড়িয়া উপজেলার কাজল দাস, অভিজিৎ সরকার আর হারজি গ্রামের সকল মানুষ সহ বঙ্গ ভিটা পেজের বন্ধুরা যাদের কল্যাণে মহাদেব দাসের ভিটেমাটির ছবি সহ পুরো ঠিকানা খুঁজে দেয়া সম্ভব হয়। নিজেদের সেই বাড়ি ও বাড়ির পাশের খাল যেখানে মহাদেব দাসের শেকড় সেই ছবি দেখে মহাদেব দাস নিশ্চয়ই ছয় যুগেরও বেশি সময় ধরে জমিয়ে রাখা অতৃপ্তি ঘুচিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন।

এখানেই ছিলেন মহাদেব দাসের বাবা প্রয়াত তারক চন্দ্র দাস, দাদা প্রয়াত বাসুদেব দাস ও দাদু প্রয়াত নবীন কুমার দাস। সময়ের পরিক্রমায় তারা এখন আরেক দেশের আরেক মানুষ। তবু এই দেশের মাটির মায়া কি অমন করে ছেড়ে দেওয়া যায়? বোধহয় না, তাইতো জীবন সায়াহ্নে সবকিছুকে ছাপিয়ে কেবলই মনে পড়ে কৈশোরের সেই আধাপাকা ঘর, কাঁদামাখা রাস্তা কিংবা ডুবোডুবি করা সেই সরু খালটির কথাই।

তাইতো জীবনান্দ দাশ লিখেছেন-

আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে – এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় – হয়তো বা শঙখচিল শালিকের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিঁকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়।
হয়তো বা হাঁস হবো – কিশোরীর – ঘুঙুর রহিবে লাল পায়
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে।
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলঙ্গীর ঢেউ এ ভেজা বাংলারি সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।

[সূত্র ও ফিচার কোলাজ ইমেজ: বিবিসি বাংলা ]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *