মোড়েলগঞ্জের পানগুছিতে এগিয়ে চলছে দেড় কিলোমিটার সেতুর প্রকল্প

কুয়েত সরকারের মালিকানাধীন কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্টের (কেএফএইডি) ঋণে দেশের সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় এক হাজার ৪০০ মিটারের (প্রায় দেড় কিলোমিটার) একটি সেতু নির্মাণ করা হবে। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলায় পানগুছি নদীর ওপর নির্মাণ করা হবে এ সেতু।‘সাইনবোর্ড-মোরেলগঞ্জ-রায়েন্দা-শরণখোলা-বগী সড়কের ১৭তম কিলোমিটারে পানগুছি সেতু নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় এটি নির্মাণ করা হবে। সেতুটি নির্মাণে খরচ হবে ৯৯৬ কোটি ৭৬ লাখ ১৪ হাজার টাকা। তার মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেবে ৫৯০ কোটি ৩ লাখ ৬৪ হাজার এবং কেএফএইডি ঋণ দেবে ৪০৬ কোটি ৭২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর। তারা এ সংক্রান্ত প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটির ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। পিইসি সভা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে—পানগুছি সেতু নির্মাণের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে উপজেলা পর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন সড়ক নেটওয়ার্কের উন্নতি এবং বাগেরহাটের সঙ্গে মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলাসহ রাজধানী এবং মোংলা বন্দরের নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন। এতে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পর্যটন শিল্পের উন্নতিও ত্বরান্বিত হবে।

প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করে সওজ অধিদফতর। সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, সেতুটি টোলযুক্ত বিধায় আর্থিকভাবে লাভজনক হবে। এছাড়া সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পর্যটন শিল্পের উন্নয়নসহ ওই এলাকার উৎপাদিত মৎস্য এবং কৃষিপণ্য স্বল্প সময়ে ও কম খরচে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য এলাকায় পৌঁছাতে পারবে এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে প্রকল্পটি লাভজনক হিসেবে সুপারিশ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বাগেরহাট সওজের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সনৎ কুমার সাহা জাগো নিউজকে বলেন, ‘সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় এ সেতুটি নির্মাণ করা হবে। সাইনবোর্ড থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবন। পানগুছি নদী হচ্ছে ১৭তম কিলোমিটার।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেতুটি হলে সুন্দরবনে যেতে খুব সুবিধা হবে। এখন ফেরিতে পারাপার হতে সময় লাগে। ওই অঞ্চলে যেসব ফসল হয়, ঘের আছে, ঘেরের মাছ, অন্যান্য কৃষিজ জিনিসপত্র আসা-যাওয়ায় সময় লাগে। সেতু হলে দ্রুত চলাচল সম্ভব হবে।’

সওজের এ উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী বলেন, শরণখোলায় পর্যটনের একটা কেন্দ্র হবে। সরকার নতুন যে কয়েকটা পর্যটন কেন্দ্র করবে, তার মধ্যে সম্ভবত শরণখোলাও আছে। পর্যটনের উন্নয়নেও সেতুটি ভূমিকা রাখবে।

প্রকল্পের পটভূমি তুলে ধরে সওজ বলছে, সাইনবোর্ড-মোরেলগঞ্জ-বায়েন্দা-শরণখোলা-বগী আঞ্চলিক মহাসড়কটি বাগেরহাট জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। এটি ব্যবহার করে মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলার জনগণ বাগেরহাট জেলা সদরসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যাতায়াত করেন। সড়কটির ১৭তম কিলোমিটারে পানগুছি নদীটি (গসিয়াখালী নামে পরিচিত) অবস্থিত হওয়ায় মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলার জনগণ সরাসরি এবং স্বল্প সময়ে বাগেরহাট জেলায় যাতায়াত করতে পারে না। বর্তমানে ওই স্থানে ফেরির মাধ্যমে যোগাযোগ চলমান আছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কেএফএইডির আর্থিক সহায়তায় এক হাজার ৪০০ মিটার সেতু নির্মাণের লক্ষ্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।

সেতুর সুস্পষ্ট নকশা নিয়ে সংশয়পরিকল্পনা কমিশনের মতামতে বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ৪০০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। তার মধ্যে মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৫০০ মিটার এবং ভায়াডাক্টের দৈর্ঘ্য ৯০০ মিটার। সেতুর মোট প্রশস্ততা ১০ দশমিক ৩ মিটার এবং এটি দুই লেনে প্রস্তাব করা হয়েছে। ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিআইডব্লিউটিএ থেকে সেতুটির ভার্টিকেল নেভিগেশনাল ক্লিয়ারেন্স ১৮ দশমিক ৩ মিটার নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া হাইড্রোলজি ও মরফোলজি স্টাডিতে সেতুটির ভার্টিকেল নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স ১৮ দশমিক ৩ মিটার নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে। ডিপিপিতে সেতুটির সুস্পষ্ট নকশা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বিধায় এর নেভিগেশনাল ক্লিয়ারেন্স ১৮ দশমিক ৩ মিটার অনুসরণ করা হয়েছে কি-না, তা সুস্পষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে ডিপিপিতে সেতুটির সুস্পষ্ট নকশা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।বিভিন্ন খাতে ব্যয় নিয়ে প্রশ্নপরিকল্পনা কমিশন তাদের মতামতে আরও বলেছে, প্রকল্পে বিভিন্ন পরামর্শক সেবা খাতে মোট ৯৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা খরচের প্রস্তাব করা হয়েছে। মাত্র এক হাজার ৪০০ কিলোমিটার সেতু নির্মাণের জন্য এত বেশি অর্থের পরামর্শক সেবার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে পিইসি সভাকে অবহিত করতে বলা হয়েছে।এক হাজার ৫০০ মিটার রিভার ট্রেনিং খাতে মোট ৬০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। রিভার ট্রেনিংয়ের কাজটি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নাকি সওজ অধিদফতরের মাধ্যমে করা হবে- তা সুস্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে পিইসি সভায় আলোচনা প্রয়োজন।

প্রকল্পে জেনারেল অ্যান্ড সাইট ফ্যাসিলিটিজ খাতে ১৯ কোটি ১৫ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ খাতের ব্যয় নির্ধারণের ভিত্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।

এ প্রকল্পেও রাখা হয়েছে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ, এতে খরচ ধরা হয়েছে এক কোটি ৬১ লাখ টাকা। বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বাদ দেয়া যেতে পারে অথবা যৌক্তিকভাবে ব্যয় কমানো যেতে পারে বলে মতামতে বলা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পে ১৭ দশমিক ৩২ মিটার ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ৭৬ কোটি ৩২ লাখ এবং পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী, এ ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে কি-না, সে বিষয়ে ডিপিপিতে কোনো নথি সংযুক্ত না থাকায় বিষয়টি স্পষ্ট নয়। জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে সংগৃহীত ব্যয় প্রাক্কলন ডিপিপিতে সংযুক্ত করতে হবে।

প্রকল্পের আওতায় মোট চারটি যানবাহন (দুটি জিপ, একটি পিকআপ, একটি মোটরসাইকেল) কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থ বিভাগের উন্নয়ন প্রকল্পের জনবল নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ড্রাইভারের সংখ্যার ভিত্তিতে যানবাহনের সংখ্যা ও ব্যয় নির্ধারণ করা যেতে পারে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় পেট্রল, ওয়েল ও লুব্রিকেন্ট খাতে ৪৭ লাখ ৮৬ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। যানবাহনের সংখ্যার ভিত্তিতে এ খাতের ব্যয় যৌক্তিকভাবে কমানো যেতে পারে।

প্রস্তাবিত প্রকল্পে ইউটিলিটি স্থানান্তর ব্যয় দুই কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। ইউটিলিটি স্থানান্তরের ব্যয় যৌথ জরিপের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সংস্থা থেকে সংগ্রহ করে নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে।

প্রস্তাবিত প্রকল্পে কর্মকর্তা-কর্মচারী, হায়ারিং চার্জ ও সিকিউরিটি সার্ভিসের জন্য জনবলের সংস্থান রাখা হয়েছে। প্রকল্পের জনবলের বিষয়ে অর্থ বিভাগের উন্নয়ন প্রকল্পের জনবল নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এক্ষেত্রে জনবল নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী জনবলের বেতন-ভাতা খাতের ব্যয় প্রাক্কলন করা যেতে পারে। এছাড়া প্রকল্পের জনবল কাঠামো ছকে নিয়োগের ধরনে প্রেষণ/সরাসরি/আউটসোর্সিং, যেখানে যা প্রয়োজন তা উল্লেখ করতে হবে।

কৃতজ্ঞতাঃ জাগো নিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *