ইন্দুরকানীর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তুরষ্কের আতাতুর্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাত্রা

পিরোজপুরের ইন্দুরকানী উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চল কলারণের আবু তাহের বিন জাকারিয়া ইউরোপের দেশ তুরস্কের আতাতুর্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুল-ফান্ডেড শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পড়তে গেছেন। কৃতি এ শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলের নির্বাহী সম্পাদক তাওসিফ এন আকবর। (কুশল বিনিময়ের পর)

দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলঃ আপনার জন্মস্থান, আপনার গ্রাম-ইউনিয়নের নাম কি?


আবু তাহেরঃ আমার নাম আবু তাহের। জন্মস্থান পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানী উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নে। আমাদের গ্রামের নাম কলারন, দক্ষিণ কলারন ৮ নং ওয়ার্ড।

দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলঃ আপনার পিতা-মাতা সম্পর্কে জানাবেন। আপনারা কয় ভাই-বোন? ভাই-বোনদের মধ্যে আপনি কততম?


আবু তাহেরঃ পিতা: মাওলানা মোহাম্মদ জাকারিয়া ইমাম কলারন বাজার মসজিদ পাশাপাশি শিক্ষকতা করছেন কলারন ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা। মাতা: ফাতিমা বেগম। আমরা চার ভাইবোন, দুই ভাই দুই বোন। আমি সবার বড়।


দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলঃ আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে বলুন। স্কুল,কলেজ এবং উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে।


আবু তাহেরঃ আমার শিক্ষা জীবন শুরু হয় বাসায়। আব্বু যেহেতু শিক্ষক সুতরাং ছোট থেকেই আমার পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। একাডেমিক পড়াশোনার শুরু মধুমালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তৃতীয় শ্রেণী থেকে কলারন ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করি এবং সেখান থেকেই অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হই।
এরপরে খুলনা দারুল কুরআন সিদ্দিকী মাদ্রাসা থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ৪.৬৭ পেয়ে এসএসসি পাস করি। এইচএসসি করি ছারছীনা দারুসুন্নাত আলিয়া মাদ্রাসায়, মানবিক বিভাগ থেকে (এ প্লাস-সহ)।
এডমিশন কোচিং করি ঢাকায় এরপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টে পড়াশোনার সুযোগ পাই এখানে দুই বছর পড়াশোনা করি।

মাঝে একটা বড় স্টোরি আছে, আমি যখন পঞ্চম শ্রেণী পাস করি তখন ঢাকায় যাচ্ছিলাম একটা মাদ্রাসায় হাফেজী পড়ার জন্য। তখন বাস এক্সিডেন্টে আমি আমার ফ্যামিলির অনেক নিয়ে এক্সিডেন্ট করি সেখানে আমার কাকি মারা যান। আমার দুইটা পা মারাত্মকভাবে আহত হয় এবং মাথায় ফ্র্যাকচার হয়। মাথার সমস্যাটা পুরোপুরি ঠিক হলেও পায়ের সমস্যা এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলঃ বিদেশে পড়ার আইডিয়াটা কিভাবে এলো? নাকি আগে থেকেই ছিল?


আবু তাহেরঃ বিদেশে পড়ার আইডিয়াটা আলিমে পড়াকালীনই প্রথম মাথায় আসে কিন্তু এডমিশনের চাপে আসলে পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। তারপরে লকডাউনের সময় যখন বাসায় বসে ছিলাম তখন আবার চিন্তা শুরু করি এবং তখন থেকেই আসলে এই জার্নিটার শুরু।

দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলঃ আপনার উচ্চশিক্ষা, বিদেশে পড়তে যাওয়া; এসব ব্যাপারে পরিবার থেকে কেমন সাপোর্ট ছিল?


আবু তাহেরঃ বিদেশের উচ্চ শিক্ষার ব্যাপারে পরিবারের সাপোর্ট বলতে আমার সব সময় মানসিক সাপোর্টটা ছিল ফ্যামিলি থেকে। বিশেষ করে আব্বু-আম্মু; তাদের আসলে এসব ব্যাপারে সত্যিকার অর্থে তেমন একটা জানাশোনা নেই। এইসব ব্যাপারে তাদের কাছে কখনো ডিটেলস বলতে হয়নি, আমার কর্মকাণ্ডের উপর মনে হয় তাদের বিশ্বাস ছিল। তাই, যখন যতটুকু হেল্প লাগছে ততটুকু পেয়েছি। আর স্কলারশিপ বা উচ্চ শিক্ষার ব্যাপারে আমার একটা বন্ধু “মোবাশ্বির বিল্লাহ”, ওর সাথে আমার সব থেকে বেশি কথা হতো এবং যাইই হোক ও-ই সব থেকে বেশি সাহায্য করছে। ও হয়তো আগামী মাসে মালয়েশিয়া যাচ্ছে আল বুখারী ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ব্যাচেলর করার জন্য।

দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলঃ জীবনে কী হতে চেয়েছিলেন? এখনও একই লক্ষ্য আছে? ভবিষ্যতে কী হতে চান?

আবু তাহেরঃ কম্পারেটিভ রিলিজিয়নে একজন বিশেষজ্ঞ এবং ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্মীয় উগ্রতা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক যদি কোন সংগঠন যেমন ওআইসি কিংবা ইউএন এর মতো কোনো সংগঠনে কাজ করার সুযোগ পাই সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।

দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলঃ বালিপাড়ার একটি প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এখন আপনি ইউরোপের দেশ তুরস্কের আতাতুর্ক ইউনিভার্সিটিতে, এই জার্নিটা কেমন ছিল?

আবু তাহেরঃ বালিপাড়া থেকে বলতে আমি যেহেতু অষ্টম শ্রেণী থেকে খুলনায় পড়াশোনা করেছি তো কখনো আসলে রিজিওনাল কোন প্রেসার আমার উপর তেমন একটা পড়েনি। খুলনার পরে বরিশাল এরপরে ঢাকায়। তো আসলে অঞ্চলের কোন প্রভাব আমার উপর খুব একটা ছিল না।

তবে হ্যাঁ, এলাকায় যদি আসলে আমার কোন সিনিয়র থাকতো বা এলাকা থেকে আমি যদি দেখতে পারতাম যে কেউ হয়তো উচ্চশিক্ষায় আছে বা বড় কোন একটা পজিশনে আছে সেটা অবশ্যই আমার মানসিক শক্তি যোগাতো। সেই জায়গাটায় আমি অনেক দুর্বল ছিলাম কারণ ওই অঞ্চল থেকে আমার পরিচিত তেমন কেউই বড় কোন স্থানে নেই কিংবা আমার জানা নেই। আমি হয়তো অনেকের ব্যাপারে জানিনা তাই।

দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলঃ শিক্ষাজীবন, বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতির সময়গুলোতে অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক কোনো বাঁধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছিলেনকি? হলে সেগুলোকে কিভাবে মোকাবিলা করেছেন?


আবু তাহেরঃ বিদেশে উচ্চ শিক্ষার প্রস্তুতি সময়ে অর্থনৈতিক তেমন কোন বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হইনি। কারণ আমি আমার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতাম। যার ফলে সবসময় আমার প্রয়োজনের যে জায়গাটা সেটা সবসময় আমার আব্বু আম্মু যথেষ্টভাবে পূরণ করছে।
তবে হ্যাঁ আরো অনেক কিছু হয়তো মিস করেছি, কিন্তু এজন্য আমার কোন আফসোস নেই। আসলে আমার যে আর্থ-সামাজিক অবস্থা ছিল সেখান থেকে আমি আমার ফ্যামিলি থেকে সর্বোচ্চ সাপোর্টটাই পেয়েছি।
আর নিজেকে অনেক কিছু ভাবতে হয়েছে যেমন উচ্চ শিক্ষার জন্য অবশ্যই আমার ফুল ফান্ডের একটা স্কলারশিপ এর দরকার ছিল। আমাকে সেটা খুঁজতে হয়েছে। আমার আসলে খুব বেশি অল্টারনেটিক ছিল না। আমার ফান্ডিংটা লাগতো পুরোপুরি কেননা বিদেশে উচ্চশিক্ষা সত্যিই অনেক ব্যয়বহুল। তো এইসব বাঁধা-বিপত্তিতে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, সবকিছু ওভারকাম করতে পেরেছি।

সামাজিক বাধা বিপত্তির ব্যাপারে হলো আমি আসলে কাউকে কিছু জানাইতাম না এই স্কলারশিপ বা বিদেশে উচ্চশিক্ষা পড়তে যাওয়ার ব্যাপারটা।

যার ফলে হয়তো এই ব্যাপারটা নিয়ে কেউ কখনো মন্তব্য করতে পারেনি। তবে ব্যক্তিগত জীবনে কিছু বাঁধা-বিপত্তির সম্মুখীন তো সবাইকেই হতে হয় আমিও তার ব্যতিক্রম নই। তবে এগুলো আসলে আমি মনেও করতে চাই না। আল্লাহ যথেষ্ট দিয়েছে।

দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলঃ গ্রাম কিংবা শহরের যে সকল শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে চায় তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি?


আবু তাহেরঃ নতুন যারা আগ্রহী বিদেশে শিক্ষার জন্য তাদের ব্যাপারে তাদের প্রতি একটি পরামর্শ হলো দেশ ছাড়তে পারো তবে দেশকে ভুলে যাওয়া যাবে না। এই জিনিসটা সবার মাথায় রাখা দরকার যে আমাদের দেশটা আমাদের, আমাদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে এর পরিবর্তনের।

আর গ্রাম থেকে যারা আসতে আগ্রহী তাদের ব্যাপারটা হল যে সত্যিকারের ডিটারমেন্টেশন, আল্লাহর প্রতি ভরসা এবং নিজের চাহিদার প্রতি বিশ্বাস যদি থাকে ইনশাল্লাহ আল্লাহ ব্যবস্থা করে দিবেন। সেক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণ ইনফরমেশন এবং সিনিয়রদের উপদেশ নেয়ার পরামর্শ থাকবে।

দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলঃ আপনাকে ধন্যবাদ!

আবু তাহেরঃ আপনাকেও। আর এ বিষয়গুলো আমারও নিজেরও স্মরণ করার দরকার ছিল সেগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য। আর আপনিও কষ্ট করছেন সেকারণে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *