
তাওসিফ এন আকবর: সারাবিশ্বে ঠোঁট ও তালুকাটা শিশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসার সর্ববৃহৎ দাতব্য সংস্থার বাংলাদেশসহ ১৭ টি দেশের সাবেক এরিয়া ডিরেক্টর ও বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় দাতব্য সংস্থা “ডি-নেট” এর নির্বাহী পরিচালক (সি.ই.ও) পিরোজপুরের ইন্দুরকানী উপজেলার কালাইয়া গ্রামের ফরাজী বাড়ির সন্তান ইঞ্জিনিয়ার মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান।
উপজেলার সদর ইউনিয়নের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মৃতঃ হাজী নূর মোহাম্মদ ও মৃতঃ আছিয়া বেগম দম্পতির ৮ সন্তানের মধ্যে ৫ম এবং ভাইদের মধ্যে তৃতীয় মোস্তাফিজুর রহমান। তার শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি হয় স্থানীয় মক্তবে তালপাতায় লেখার মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে ১৩ নং ইন্দুরকানী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। প্রায় যোগাযোগব্যবস্থাহীন দুই কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে, নানাবিধ বিঘ্নতা উপেক্ষা করে সেখানে তিনি নিয়মিত ক্লাস করতেন। এতসব সীমাবদ্ধতার পরও একই শ্রেণিতে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। এছাড়াও তিনি তার শিক্ষাজীবনের প্রায় সকল স্তরেই প্রথম স্থান বজায় রাখেন।
১৯৭৫ সালে মফস্বলের(তৎকালীন) এই স্কুলটি থেকেই তিনি ৫ম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলে সমগ্র জেলার মধ্যেও প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন ইন্দুরকানী মেহেউদ্দিন পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ১৯৮১ সালে যশোর বোর্ডের অধীনে বিজ্ঞান বিভাগে কৃতিত্বের সাথে (৪ সাবজেক্টে লেটারমার্কসহ) উত্তীর্ণ হন। যা সেসময় স্কুলটির ইতিহাসের সর্বোচ্চ ফলাফল ছিল।
ইন্টারমিডিয়েটে তিনি তৎকালীন পিরোজপুর সরকারি কলেজ (বর্তমান সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ) এ ভর্তি হন এবং ১৯৮৩ সালে সংগঠিত সামরিক শাসন ও বিরোধী আন্দোলনে সারাদেশে ফলাফল বিপর্যয়ের পরও তিনি ১ম বিভাগে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। উল্লেখ্য সেবছর যশোর বোর্ডের পাশের হার ছিল ১৯.৪।
ইন্টারমিডিয়েটের পর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকাতে চলে আসেন। এরপর (১৯৮৩-১৯৮৪) সেশনে কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরি অনুষদে ভর্তির সুযোগ পান ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯০ সালে (স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে হওয়া সেশনজট এ পড়েন ) তিনি সেচ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন।
শিক্ষাজীবনে তিনি অষ্টম শ্রেণি থেকে অন্তত ৭ টি বাড়িতে জায়গির থেকেছেন( স্থানীয় ভাষায় লজিং থাকা)। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও তিনি গৃহশিক্ষকের কাজ তথা টিউশনি করে নিজের যাবতীয় খরচ যুগিয়েছেন।
গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করার পরপরই তিনি তৎকালীন জার্মান টেকনিক্যাল কো-অপারেশন ( জি.টি.জেড) এর অর্থায়নে টাঙ্গাইল এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে সেচ প্রকৌশলী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রজেক্টেটি শেষ হওয়ার পরে তিনি ১৯৯৩ সালে তৎকালীন ইউরোপীয় কমিশন (বর্তমান ইউরোপীয় ইউনিয়ন) এর অর্থায়নে ২০০ মিলিয়নের “রংপুর রিজিওনাল রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম” (আর.ডি-৮ ও আর.ডি-৯) এ প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন।
এরপরে ১৯৯৬ সালে তিনি নেদারল্যান্ড সরকারের বৃত্তি নিয়ে সেখানকার বিখ্যাত ও বিশ্বের সবচেয়ে বড় পানিবিষয়ক স্নাতক শিক্ষার সুবিধাসম্বলিত বিশ্ববিদ্যালয় ” আই.এইচ.ই ডেলফ ইন্সটিটিউট ফর ওয়াটার এডুকেশন” (সাবেক ইউনেস্কো আই.এইচ.ই ইন্সটিটিউট ফর ওয়াটার এডুকেশন) থেকে “ইঞ্জিনিয়ারিং হাইড্রোলজি” তে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
নেদারল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান “ন্যাশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান” এ কনসালটেন্ট-গ্রাউন্ড ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগদান করেন। প্রজেক্টটি শেষ হবার পর তিনি সিনিয়র প্ল্যানিং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে “ডি.এইচ.ভি কনসালট্যান্ট” এ হিসেবে কাজ শুরু করেন।
এই সংস্থার মাধ্যমে তিনি দেশের প্রথম উড়ালসেতু “মহাখালী ফ্লাইওভার”, ঢাকা-চট্রগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কসহ দেশের উল্লেখযোগ্য বিখ্যাত কিছু স্থাপনা নির্মাণের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।
তিনি ২০০১ সালে একই সংস্থা (ডি.এইচ.ভি কনসালট্যান্ট) এর হয়ে প্রথমবারেরমত দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক এসাইনমেন্টে সংযুক্ত হন। এসময় তিনি আফ্রিকার শিং খ্যাত ইথিওপিয়াতে কমিউনিটি ডেভলপমেন্ট স্পেশালিষ্ট হিসেবে বছরখানেক কাজ করেন।
২০০২ সালে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এ.ডি.বি) এর অর্থায়নে একটি প্রজেক্টের “প্রজেক্ট ম্যানেজার” হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি আফগানিস্তানে আন্তর্জাতিক সংস্থা “কোপারেজেনি ইন্টারন্যাশনালি ” (COOPI) এর প্রোগ্রাম ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেন। ২০০৫ সালের জুলাইতে তিনি একই প্রজেক্টের (৫০ মিলিয়ন ডলারের) পদোন্নতি পেয়ে কান্ট্রি ডিরেক্টর হন।একই সাথে তিনি আফগানিস্তান, সুদান ও দক্ষিণ সুদানের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০০৭ সাল পর্যন্ত।
২০০৮ সালের জানুয়ারিতে “সেভ দ্য চিলড্রেন-ইউ.এস.এ” এর অধীনে পাকিস্তানে ৬০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রজেক্টে চীফ অব পার্টি (প্রোগ্রাম ডিরেক্টর)হিসেবে যোগদান করেন। এখানে তিনি কাজ করেন ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত। এই সময়ে ২০১১ সালে তিনি সেখানকার বিখ্যাত “প্রেসটন ইউনিভার্সিটি ” থেকে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে এম.বি.এ ডিগ্রি অর্জন করেন।
এছাড়াও তিনি বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শর্টকোর্স, শর্টট্রেনিং এবং খণ্ডকালীন ডিগ্রিও অর্জন করেন।
তিনি মার্চ ২০১৩ থেকে একই বছরের আগষ্ট পর্যন্ত আফ্রিকার দেশ সোমালিয়াতে “সেভ দ্য চিলড্রেন ” এর হেড অব মিশন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে দেশে ফিরে একই অর্গানাইজেশনের বাংলাদেশ প্রোগ্রাম (অধ্যায়) এর প্রোগ্রাম এডভাইজরের দায়িত্বও পালন করেন।
২০১৪ সালের শুরুতে তিনি ঠোঁটকাটা ও তালুকাটা শিশুদের নিয়ে কাজ করা বিশ্বের সবচেয়ে বড় অলাভজনক দাতব্য সংস্থা “স্মাইলট্রেন ইউ.এস.এ” এর বাংলাদেশ প্রোগ্রামের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময়ে সংস্থাটি সারাদেশে ৩০ টি হাসপাতালের সাথে অংশীদারত্বের মাধ্যমে অন্তত ৬০ হাজার ঠোঁট ও তালুকাটা শিশুদের বিনামূল্যে প্লাস্টিক সার্জারি করে।
পরবর্তীতে কর্মদক্ষতা ও সফলতার ভিত্তিতে তিনি “স্মাইলট্রেন”এ জুলাই ২০১৮ সালে বাংলাদেশসহ মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার ১৭ টি দেশের এরিয়া ডিরেক্টর হিসেবে পদোন্নতি পান। এসময়ে তিনি ১৭ টি দেশের ১২০ টি অংশীদার হাসপাতালের মাধ্যমে ১২০ মিলিয়ন ডলারের দাতব্য কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
সর্বশেষ ২০২১ সালের জানুয়ারিতে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা ” ডি-নেট সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ ” এর প্রধান নির্বাহী (সি.ই.ও) হিসেবে যোগদান করেন এবং বর্তমানে তিনি সেখানেই কর্মরত আছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে দুই সন্তানের জনক ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফিজুর রহমান। তার স্ত্রী-ও একজন ইঞ্জিনিয়ার। বড় ছেলে লন্ডনের পাবলিক রিসার্চ ইউনিভার্সিটি “ব্রুনেল ইউনিভার্সিটি” তে ল’ এ অধ্যয়নরত এবং বার এট ল’ সম্পন্ন করবেন। ছোট ছেলে-ও একই ইউনিভার্সিটিতে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছেন।
চাকুরিজীবনে কখনো সরকারি চাকুরির পেছনে না ছুটেও দেশ-বিদেশে নিজের কৃতিত্বে বলিয়ান ব্যক্তিত্ব ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফিজুর রহমান বিশ্বাস করেন কর্মদক্ষতায়। পছন্দ করেন দাতব্য কার্যক্রম পরিচালনা করতে ও অসহায় মানুষদের পাশে থাকতে। ব্যক্তিজীবনে সফল এই মানুষটি বিশ্বাস করেন সৎ ইচ্ছা, কর্মদক্ষতা এবং বড় হওয়ার বাসনা থাকলে শিক্ষাজীবনে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা।
Excellent
Successful
IT IS MY PLEASURE TO MENTION YOU ALL THAT WE HAVE SUCH A VRRY GOOD PERSONALITY IN OUR LOCALITY. HE IS OUR PRIDE.